আজ ২রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগকৃত কিশোরগঞ্জের যুদ্ধাপরাধীদের মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলায় হতাশা শহীদ কন্যা ওয়াহিদা আহমেদসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ;

ভোরের আলো বিডিঃ মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগকৃত কিশোরগঞ্জের যুদ্ধাপরাধীদের মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলায় হতাশা ব্যক্ত করছেন শহীদ কন্যা ওয়াহিদা আহমেদ সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক,তাড়াইল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক এবি মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১সনের ১০নভেম্বর কিশোরগঞ্জের কাঁচারী বাজার হতে আলবদর জহিরুল হক, শহীদুল্লাহ ফকির, প্রফেসর মাহতাব উদ্দিন কর্তৃক ধৃত হয়ে নিঁখোজ হবার পর হতে অদ্যাবধি কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা আতাউর রহমান ২০১৭সালে তদন্তে আসেন কিশোরগঞ্জে এবং তথ্য সংগ্রহ করেন। ২০১৮ সালেও কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউজে অবস্থান নেন অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওই তদন্ত কর্মকর্তা। এ সময় তাড়াইল হতে ১৭জন সাক্ষী আলবদর কমান্ডার অ্যাডভোকেট জহিরুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে।
তৃতীয়বার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কো-অর্ডিনেটর এম সানাউল হক নিজে ও তদন্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান কিশোরগঞ্জ ডাকবাংলোতে আসেন। সেখানেও এবি মহিউদ্দিন আহমেদের হত্যাকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে সাক্ষ্য প্রদান করেন। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জের আলবদর শহীদুল্লাহ ফকিরকে গ্রেফতার করা হয় একই মামলায়। তা ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
তারই প্রেক্ষিতে শহীদ পরিবারের পক্ষে ওয়াহিদা আহমেদ ২০১৮সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের পরিবারের সদস্যগণকে নিয়ে ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তারপরও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম চত্বরে ২০১৮সালের ২০আগস্ট আবারও পরিবারের সকলসদস্যসহ মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অনতিবিলম্বে বিচার কার্য ত্বরান্বিত করার জোর দাবি জানান।
এখন চলছে ২০২২সাল। ২০১৭ সাল হতে ২০২২সাল পর্যন্ত ৬বছরে মামলার কোনো প্রকার অগ্রগতি না হওয়ায় শহীদ পরিবারের সদস্যগণ হতাশায় ভূগছেন। আলবদর জহিরুল হক মামলার বিলম্ব হবার সুযোগে সাক্ষীদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে যাতে তারা ভয়ে কেহ ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিতে না পারে।
উল্লেখ্য যে, এবি মহিউদ্দিন আহমেদ কিশোরগঞ্জ জেলাধীন হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের অধিবাসী। তিনি ১৯৭১ সনে কিশোরগঞ্জ শহরের শিক্ষক পল্লীতে বাস করতেন। সেখান থেকে তিনি তাড়াইল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন একই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন জহিরুল হক। বলছি ১৯৭১সালের কথা। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে চলছিল চরম উত্তাপ। এবি মহিউদ্দিন আহমেদ বলতেন নিজ দেশের অধিকার নিয়ে। আর জহিরুল হক বলতেন পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি নিয়ে। চলতো দুজনের বাক-বিতন্ড। এরই মধ্যে শুরু হল পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। ১৯৭১সালের ২৫মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালীদের ওপর। এদিকে একই স্কুলে থাকা প্রধান শিক্ষক এবি মহিউদ্দিন আহমেদ ও জহিরুল হক উভয়ের মাঝে বিতর্ক-উত্তেজনা বেড়েই চলছে। উভয়ের মাঝে মারমুখো অবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে এবি মহিউদ্দিন জীবন দিতে প্রস্তুত। অপরদিকে জহিরুল হকও পাকিস্তানের জন্য জান কোরবান করতে জেহাদী জোশে হাঁক দিয়ে চলছে। এবি মহিউদ্দিন স্বাধীনবাংলার স্বাধীনতাকামী হিসেবে নিজ স্বাক্ষরে লোক পাঠাতেন ভারতে মুক্তিযুদ্ধে। অপরদিকে জহিরুল হক আলবদরে ও রাজাকারে লোক পাঠাতেন। এরি মধ্যে জহিরুল হক নিজেও আলবদরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পাবার আগে নিজে আলবদরে ট্রেনিং নেন। চরম উত্তেজনায় চলতে থাকে এ দুজন শিক্ষকের মধ্যে। এবিমহিউদ্দিন আহমেদকে যে কোনো দিন শেষ করে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল আলবদর জহিরুল। এ হুমকিতে মহিউদ্দিন আহমেদ খুব সতর্ক থাকতেন। আলবদর জহিরুল হক মহিউদ্দিন আহমেদের কিশোরগঞ্জ-টু-তাড়াইলের আসা যাওয়ার খোঁজখবর রাখতেন।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হবার দ্বারপ্রান্তে তখন সারাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যার নীলনকশা চলছিলো। সেই নীলনকশাঁর মুহুর্তে ‘৭১সালের ১০নভেম্বর কিছুটা অসতর্ক অবস্থায় এবি মহিউদ্দিন বাজার করতে আসেন কিশোরগঞ্জের কাঁচারীবাজারে। জহিরুল হক খবর পেয়ে আরেকজন আলবদরকে সঙ্গে নিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদকে পাকড়াও করে। এ মূহুর্তে কাজল নামের একটি ছেলে এবি মহিউদ্দিনের সঙ্গী হিসেবে ছিলেন। সেই ছেলেটি তাৎক্ষনিক দৌড়ে গিয়ে গাইটালস্থ শিক্ষকপল্লীর বাসায় এবি মহিউদ্দিন আহমেদের পরিবারকে ঘটনাটি জানিয়ে আসেন। এই কঠিন মূহুর্তে পরিবারের লোকজন খবর নিতে কাঁচারীবাজার আসেন। কিন্তু আলবদরের হাতে ধৃত মহিউদ্দিন আহমেদকে ঘটনাস্থলে আর পাওয়া যায়নি। তবে তার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন রামানন্দ হাইস্কুলের শিক্ষক আবদুর রশিদ হেড মাওলানা। এ হেড মাওলানা এবিমহিউদ্দিন আহমেদের শিক্ষক ছিলেন। তাই মহিউদ্দিন আহমেদ ওনার স্যারকে কাঁচারীবাজারে পেয়ে চিৎকার দিয়ে বললেনঃ “স্যার আমাকে জহিরুল ও অন্যরা তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আমাকে বাঁচান।” এ কথা বলার পর হেডমাওলানা আবদুর রশিদ চেষ্টা করলেন তাকে ছাড়াতে। কিন্তু আঃ রশিদ সাহেবকে আলবদররা বললেন আপনি ডাকবাংলোয় আসেন। তখন মাওলানা আঃ রশিদ সাহেব কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের সন্নিকটে ডাকবাংলোতে গেলেন। হেড মাওলানার সাথে তার ছোট ছেলে শামছুজ্জামানও (দন্তচিকিৎসক)সঙ্গে ছিলেন। সেই শামছুজ্জামানও একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারপর ওই ডাকবাংলোতে গিয়ে হেডমাওলানা আবদুর রশিদ সাহেব দেখলেন সেখানে জহিরুল হক, শহীদুল্লাহ ফকির, প্রফেসর মাহতাব উদ্দিন, মাওঃ সোহরাব উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন। মাওঃ আবদুর রশিদ সাহেব সবার শ্রদ্ধার লোক ছিলেন। তারপরও ওনার হাতে এবি মহিউদ্দিন আহমেদকে তুলে দেয়নি। মাওলানার নিজের ছাত্রছিলেন বিধায় তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আফসোস করে ফিরে এলেন। তারপর তাকে নিয়ে উত্তরদিকে নিয়ে গেছেন বলে খবর পাওয়া যায় কিন্তু নিখোঁজ এবি মহিউদ্দিন আহমেদ এর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আজ এই শহীদ এবি মহিউদ্দিন আহমেদের পরিবার হন্যে হয়ে ঘুরছে বিচার পাবার আশায়। শহীদ পরিবার আশা করছিলো তারা এ হত্যাকান্ডের বিচার পাবে। কিন্তু তদন্তের স্থবিরতা দেখে তাদের নেমে এসেছে হতাশা। আজ তারা তারা এ শহীদের বিচার চায়। শহীদ কন্যা ওয়াহিদা আহমেদ বলেনঃ “যারা সাক্ষী দিয়েছে তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমি বিচারের জোর দাবি জানাচ্ছি। আমি তখন ছোট ছিলাম কিন্তু সাক্ষীরা তো এই হত্যাকান্ডের ঘটনা জানে। তারা প্রত্যক্ষভাবে জেনে শুনেই সাক্ষী দিয়েছে। আমি তাদের সাক্ষীর প্রেক্ষিতে দ্রুতবিচার প্রার্থনা করছি। খুনিরা সাক্ষীদেরকে হুমকী দিয়ে এ মামলাটি বাধাগ্রস্থ করতে চায়। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আলবদররা যে কোনো মূহুর্তে আমাদেরও জীবন নাশ করতে পারে। তাই আমি ওয়াহিদা আহমেদ শহীদের কন্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের দ্রুত বিচার প্রার্থনা করছি। সাথে সাথে সাক্ষী সুরক্ষা আইন করে সাক্ষীদের নিরাপত্তাবিধানের জোর দাবি করছি।” এ শহীদের বিচার করা না হলে আলবদর ও রাজাকার গোষ্ঠী যে কোনো মূহুর্তে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারে। তাই সকল দেশপ্রেমিক মানুষ এ হত্যাকান্ডের বিচার চায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেই দিকটা বিবেচনায় রেখে ট্রাইব্যুনালকে কাজ করতে হবে বলে সুধীজনরা মতামত ব্যক্ত করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category